প্রশ্নঃ দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে?
উত্তরঃ দ্বিরুক্ত অর্থ দু'বার উক্ত বা বলা হয়েছে এমন। বাংলা ভাষায় কোনো কোনো শব্দ একবার ব্যবহার করলে যে অর্থ প্রকাশ করে সেগুলো দু'বার ব্যবহার করলে অন্য কোন সম্প্রসারিত বা সংকুচিত অর্থ প্রকাশ করে। এ ধরনের শব্দের পরপর দু'বার প্রয়োগেই দ্বিরুক্ত শব্দ গঠিত হয়। যেমন- আমার ঘুম ঘুম লাগছে। অর্থাৎ ঠিক ঘুম নয়, ঘুমের ভাব অর্থে এই প্রয়োগ করা হয়েছে, এছাড়াও ‘আমার জ্বর জ্বর লাগছে।’ এখানে ‘জ্বর জ্বর’ দ্বিরুক্ত শব্দটি ঠিক ‘জ্বর’ অর্থ প্রকাশ করছে না। জ্বরের ভাব প্রকাশ করছে। দ্বিরুক্ত শব্দকে ভাঙলে পাওয়া যায় ‘দ্বি+উক্ত’। অর্থাৎ, যেটি দুইবার বলা হয়েছে।
প্রশ্নঃ দ্বিরুক্ত শব্দের গঠনগত দিক সম্পর্কে বিস্তারিত লিখুন।
উত্তরঃ গঠনগত দিক থেকে বাংলা ভাষার দ্বৈতশব্দ বা দ্বিরুক্ত শব্দকে তিনভাগে ভাগ করা যায়:
১) একই শব্দের পুনরাবৃত্তি/শব্দের দ্বিরুক্তি
২) পদের দ্বিরুক্তি
৩) অনুকার দ্বিরুক্তি/ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি
একই শব্দের পুনরাবৃত্তি/শব্দের দ্বিরুক্তি
একই শব্দ যখন অবিকৃতভাবে দু'বার উচ্চারিত হয় তখন তাকে শব্দের দ্বিরুক্তি বলে। শব্দের দ্বিরুক্তিতে কোন পদের পরিবর্তন হয় না, কেবল অর্থের পরিবর্তন হয়।যেমন- দিন দিন, রোজ রোজ, লাল লাল, কেউ কেউ, পাকা পাকা।
শব্দের দ্বিরুক্তি নানা রকম হতে পারে
→ক. একই শব্দ অবিকৃতভাবে দুইবার ব্যবহৃত হয়ে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠন করতে পারে। যেমন- ভাল ভাল বই, ফোঁটা ফোঁটা জল, বড় বড় বাড়ি, ইত্যাদি।
→খ. একই শব্দের সাথে সমার্থক আর একটি শব্দ যোগ করে। যেমন: মান- সম্মান, হিসাব-নিকাশ, ভয়-ভীতি, ধন-দৌলত, বলা-কওয়া, টাকা-পয়সা।
→গ. সহচর শব্দযোগে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠিত হতে পারে। দুটি সম্পর্কিত শব্দকে সহচর শব্দ বলা যায়। যেমন, ‘কাপড়-চোপড়’ সহচর শব্দযোগে গঠিত দ্বিরুক্ত শব্দ। ‘কাপড়’ অর্থ গা ঢাকার জন্য যেসব পরা হয়। আর কাপড়ের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে যেগুলো পরা হয় সেগুলোই ‘চোপড়’। অর্থাৎ, এই দুটি শব্দ পরস্পর সম্পর্কিত। তাই এই দুটি শব্দ সহচর শব্দ। এরকম- লালন-পালন, খোঁজ-খবর, ইত্যাদি।
→ঘ. দ্বিরুক্ত শব্দ-জোড়ার দ্বিতীয় শব্দটির আংশিক পরিবর্তন করে। যেমন- ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি, ভাগাভাগি ইত্যাদি ।
→ঙ. একই শব্দ দুইবার ব্যবহৃত হয়ে পরেরবার একটু পরিবর্তিত হয়ে দ্বিরুক্ত শব্দ হতে পারে। যেমন- মিট-মাট, ফিট-ফাট, বকা-ঝকা, তোড়-জোড়, গল্প-সল্প, রকম-সকম, ইত্যাদি।
→চ. বিপরীতার্থক শব্দযোগেও দ্বিরুক্ত শব্দ গঠিত হতে পারে। যেমন- লেন-দেন, দেনা-পাওনা, ধনী-গরিব, আসা-যাওয়া, ইত্যাদি।
দ্বিরুক্তি শব্দ বাক্যে প্রয়োগ
ক. গলায় গলায়: রহিম ও করিমের গলায় গলায় ভাব।
খ. বন্ধু-বান্ধব: বন্ধু-বান্ধব সব ছেড়ে নির্বাসনে যাচ্ছি।
গ. রোগ-শোক: রোগ-শোকের সাথে নিত্য বসতি জেলেপাড়ার লোকদের।
ঘ. ভয়-ডর: দস্যি ছেলেটার নাহি আছে ভয়-ডর।
ঙ. হিসাব-নিকাশ: জীবনের খাতায় হিসাব-নিকাশ করে ফলাফল হলো শূন্য।
চ. কুলি-মজুর: কুলি-মজুরের গান গেয়ে যাই ভালোবাসি কুলি-মজুরকে।
ছ. লাজ-লজ্জা: লাজ-লজ্জা রেখে এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।
জ. দিনে দিনে: দিনে দিনে সময় গিয়েছে চলে আসনি তুমি কাছে।
ঝ. দোষ-গুণ: দোষে-গুণেই মানুষ হয় পূর্ণ মানুষ ।
ঞ. শীত-বসন্ত: শীত-বসন্ত চলে গিয়ে আজ এসেছে বর্ষা রাতি প্রেয়সী আমার সেই যে গিয়াছে এখনো আসেনি ফিরি।
পদের দ্বিরুক্তি
একই বিভক্তিযুক্ত পদের দ্বিরুক্তিকে পদের দ্বিরুক্তি বলে। পদের দ্বিরুক্তিতে দ্বিতীয় পদের ধ্বনিগত পরিবর্তন হলেও বিভক্তির কোন পরিবর্তন হয় না। যেমন- ভালোয় ভালোয়, হেসে হেসে, কে কে, কার কার।
→ক. একই পদ অবিকৃতভাবে পরপর দুইবার ব্যবহৃত হয়ে। যেমন- ঘরে ঘরে লেখাপড়া হচ্ছে। দেশে দেশে ধন্য ধন্য পড়ে গেলো। মনে মনে আমিও এ কথাই ভাবছিলাম।
→খ. দ্বিতীয় পদ কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে। তবে এক্ষেত্রেও পদ-বিভক্তি অপরিবর্তিত থাকে। অর্থাৎ, মূল শব্দ কিছুটা পরিবর্তিত হয়, কিন্তু বিভক্তি অপরিবর্তিত থাকে। যেমন- আমরা হাতে-নাতে চোরটাকে ধরেছি।
→গ. সহচর, সমার্থক বা বিপরীতার্থক শব্দ একই বিভক্তি যুক্ত হয়ে পরপর ব্যবহৃত হয়ে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠন করতে পারে। যেমন- আমার সমত্মান যেন থাকে দুধে-ভাতে। দেশে বিদেশে বইটি লিখেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী, আর পথে-প্রবাসে লিখেছেন মুহম্মদ এনামুল হক।
দ্বিরুক্তি শব্দ বাক্যে প্রয়োগ
□ ক. বিশেষ্য শব্দ যুগলের বিশেষণরূপে ব্যবহার:
১. আধিক্য বোঝাতে: রাশি রাশি ভারা ভারা, রাশি রাশি ধন, ধামা ধামা ধান।
২. সামান্য বোঝাতে: আমার কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। দেখেছ তার কেমন কবি কবি ভাব।
৩. পরস্পরতা বা ধারাবাহিকতা বোঝাতে: তুমি দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছ। থোকা থোকা ফুল ফুটছে।
৪. ক্রিয়া-বিশেষণ: ধীরে ধীরে যায়, ফিরে ফিরে চায় ৷
৫. অনুরূপ কিছু বোঝাতে: তার সঙ্গী-সাথী কেউ নেই।
□ খ. বিশেষণ শব্দযুগলের বিশেষণরূপে ব্যবহার:
১. আধিক্য বোঝাতে: কচি কচি ডাব নিয়ে আস। সুন্দর সুন্দর ফুল তুলে আন ।
২. তীব্রতা বা সঠিকতা বোঝাতে: গরম গরম জিলাপী। নরম নরম হাত।
৩. সামান্যতা বোঝাতে: উডু উডু ভাব। কালো কালো চেহারা। পচা পচা গন্ধ ।
□ গ. সর্বনাম শব্দ:
বহুবচন বা আধিক্য বোঝাতে: সে সে লোক গেল কোথায়? কে কে গেল? কেউ কেউ বলে সে নাকি রূপসী।
□ ঘ. ক্রিয়াবাচক শব্দ:
১. বিশেষণরূপে: এ দিকে রোগী বুঝি যায় যায়। এত খাই খাই করা ভালো নয়। তোমার নেই নেই ভাব আর গেল না ৷
২. স্বল্পকাল স্থায়ী বোঝাতে: দেখতে দেখতে আকাশ কালো হয়ে এল।
৩. ক্রিয়া-বিশেষণ: দেখে দেখে যেও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনলে কীভাবে?
৪. পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে: ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেছি।
□ ঙ. ক্রিয়াবাচক শব্দ:
১. ভাবের গভীরতা বোঝাতে: ছি ছি তুমি কী করেছ? আর হায় হায় করে লাভ কি! যা হবার তা হয়েছে।
২. পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে: বারবার কামান গর্জে উঠল।
৩. অনুভূতি বা ভাব বোঝাতে: ভয়ে গা ছম ছম করছে। ফোঁড়াটা পেকে টনটন করছে।
৪. ধ্বনিব্যঞ্জনা বোঝাতে: ঝির ঝির করে বাতাস বইছে। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর ।
৫. বিশেষণ বোঝাতে: পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।
ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি
কোনো কিছুর স্বাভাবিক আওয়াজ বা ধ্বনির অনুকরণে গঠিত শব্দকে ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি বলে । যেমন- টিপ্ টিপ্, টিক্ টিক্, শন্ শন্।
□ ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দ কয়েকটি উপায়ে গঠিত হয়:
১. মানুষের ধ্বনির অনুকার: ভেউ ভেউ-মানুষের উচ্চ কান্নার ধ্বনি। এরূপ-ট্যা ট্যা, হি হি ইত্যাদি।
২. জীবজন্তুর ধ্বনির অনুকার: ঘেউ ঘেউ (কুকুরের ধ্বনি) এরূপ- মিউ মিউ (বিড়ালের ডাক), কুহু কুহু (কোকিলের ডাক), কা কা (কাকের ডাক)
৩. বস্তুর ধ্বনির অনুকার: ঘচাঘচ (ধান কাটার শব্দ), মড়মড় (গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ), ঝমঝম (বৃষ্টি পড়ার শব্দ; হু হু (বাতাস প্রবাহের শব্দ)।
৪. অনুভূতিজাত কাল্পনিক ধ্বনির অনুকার: ঝিকিমিকি (ঔজ্জ্বল্য), ঠা ঠা (রোদের তীব্রতা)। এরূপ-মিনমিন, পিটপিট, ঝি ঝি ইত্যাদি।
□ ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি গঠন:
১. একই শব্দের অবিকৃত প্রয়োগ: ধব ধব, ঝন ঝন, পট পট।
২. প্রথম শব্দটির শেষে আ যোগ করে: গপাগপ, টপাটপ, পটাপট।
৩. দ্বিতীয় শব্দটির শেষে ই যোগ করে: ধরাধরি, ঝমঝমি, ঝনঝনি ।
৪. যুগ্মরীতিতে গঠিত ধ্বন্যাত্মক শব্দ: কিচির মিচির (পাখির বা বানরের শব্দ), টাপুর টুপুর (বৃষ্টিপতনের শব্দ), হাপুস হুপুস।
৫. আনি প্রত্যয়যোগেও বিশেষ্য দ্বিরুক্তি গঠিত হয়- যেমন: পাখিটার ছটফটানি দেখলে কষ্ট হয়। তোমার বকবকানি আর ভালো লাগে না।
□ ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দের বিভিন্ন পদরূপে ব্যবহার:
১. বিশেষ্য: বৃষ্টির ঝমঝমানি আমাদের অস্থির করে তোলে।
২. বিশেষণ: ‘নামিল নভে বাদল ছলছল বেদনায়।’
৩. ক্রিয়া: 'কলকলিয়ে উঠল সেথায় নারীর প্রতিবাদ।'
৪. ক্রিয়া বিশেষণ: ‘চিকচিক করে বালি কোথা নাহি কাদা।'
▪ বিশিষ্টার্থক বাগধারায় দ্বিরুক্ত শব্দের প্রয়োগ
১. সতর্কতা বোঝাতে: ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখো।
২. ভাবের প্রগাঢ়তা বোঝাতে: ভুলগুলো তুই আনরে বাছা বাছা।
৩. কালের বিস্তার বোঝাতে: থেকে থেকে শিশুটি কাঁদছে।
৪. আধিক্য বোঝাতে: লোকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান।
▪ যুগ্মরীতিতে শব্দের দ্বিরুক্তি গঠন পদ্ধতি
যুগ্মরীতির দ্বিরুক্তি: একই শব্দকে কিঞ্চিত পরিবর্তন করে দ্বিতীয়বার ব্যবহার করার নাম যুগ্মরীতির দ্বিরুক্তি।
নিয়মাবলি:
ক. শব্দের আদিস্বর পরিবর্তন করে- চুপ-চাপ, ধুম-ধাম, দ্রিম দ্রাম, মিট-মাট, টাপুর টুপুর ।
খ. শব্দের অন্তস্বরের পরিবর্তন করে- মারামারি, কোলাকুলি, হাতাহাতি, সরাসরি।
গ. দ্বিতীয়বার ব্যবহারে শব্দের ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তনে- ছট-ফট, নিশ-পিশ, ভাত-টাত ৷
ঘ. সমার্থক শব্দযোগে- চাল-চলন, রীতি-নীতি, বন-জঙ্গল।
ঙ. ভিন্নার্থক শব্দযোগে- ছোট-বড়, আসা-যাওয়া, জন্ম-মৃত্যু।
চ. বিপরীতার্থক শব্দযোগে- ডাল-ভাত, তালা-চাবি, পথ-ঘাট, অলি-গলি।
ছ. সহচর শব্দযোগে- কাপড়-চোপড়, হাতে-নাতে।