কারকের সংজ্ঞা: নামপদের বা বিশেষ্যের সাথে ক্রিয়া পদের যে সম্পর্ক বা অন্বয় তাকে কারক বলে।
সম্বন্ধপদ কারক নয় কেন: ক্রিয়াপদ ছাড়া অন্যান্য পদের সাথে বিশেষ্য বা নামপদের যে সম্বন্ধ তা কারক নয়। এই প্রকার সম্বন্ধও কারকের মত বিভক্তি যোগে হয়ে থাকে। যেমন- ‘রহিমের বই’। এখানে ‘বই’ এই বিশেষ্যের সাথে রহিম এই শব্দের সম্বন্ধ, এখানে বিভক্তি ‘এর’ দ্বারা সম্বন্ধ দেখানো হয়েছে। ‘রহিম’ ও ‘বই’ এই দুটোশব্দের মধ্যে ক্রিয়া বা ঘটনা নেই। এখানে রহিমের হল সম্বন্ধ পদ। কাজেই সম্বন্ধ পদে যেহেতু ক্রিয়ার কোন স্থান নেই সেজন্য সম্বন্ধ পদ কারক নয়।
সম্বোধন পদ কাকে বলে: যে পদ দ্বারা কাউকে সম্বোধন বা আহ্বান করা হয় তাকে সম্বোধন পদ বলে। যেমন- কাকা, কলমটা দাও। ভাই, কেমন আছ। সম্বোধন পদের সাথে ক্রিয়ার কোন সম্পর্ক নেই, তাই একে কারক বলা যায় না। তবে ওগো, ওলো, ওহে, হে, হ্যালো ইত্যাদি সম্বোধন পদ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়।
বাংলা কারক ও ইংরেজি case এক জিনিস নয় কেন: বাংলায় বাক্যে ক্রিয়ার সাথে অন্যান্য পদের যে সম্পর্ক বা অন্বয় তাকে কারক বলে। কাজেই কর্তা, কর্ম, করণ, সম্প্রদান, অপাদান, অধিকরণ, প্রভৃতি সম্পর্ক নিয়ে ছয় প্রকার কারক হয়। সম্বন্ধ ও সম্বোধন পদের সাথে ক্রিয়ার সম্পর্ক নেই বলে তা কারক নয়। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় শুধুমাত্র Noun (বিশেষ্য) এর সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের যে সম্পর্ক তাকে case বলে। বাংলাতে ক্রিয়া যেমন কারকের ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি, অন্যদিকে ইংরেজিতে বিশেষ্য পদ মূল ভিত্তি। ইংরেজিতে সম্বন্ধ পদ (possessive case) ও সম্বোধন পদকে (vocative case) ও কারক বলা হয়। বাংলায় বলা হয় না। কাজেই কারক ও case বস্তুত এক জিনিস নয়।
বিভিন্ন প্রকার কারকের উদাহরণ: কারক ছয় প্রকার :
১) কর্তৃকারক,
২) কর্মকারক
৩) করণকারক,
৪) সম্প্রদান কারক,
৫) অপাদান কারক,
৬) অধিকরণ কারক।
১) কর্তৃকারক বা কর্তাকারক: ক্রিয়ার সাথে কর্তা সম্পর্ক নিয়ে কর্তা বা কর্তৃকারক হয়। কর্তাকারকে শূন্য বিভক্তি বা প্রথমা বিভক্তি বেশি হয়। জল পড়ে, পাতা নড়ে। কোকিল ডাকে। নবীন স্কুলে যায়। বৃষ্টি পড়ে। এগুলো প্রথমা বিভক্তির উদাহরণ।
কর্তৃকারকে বিভিন্ন বিভক্তির উদাহরণ: ১মা বিভক্তি : গরুতে ঘাস খায়। লোকে বলে। তাকে বলা হয়। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া। পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল। ২য় বিভক্তি : তোমাকে যেতে হবে। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। লোকটিকে চেনা মনে হয়। ছেলেটিকে ডাক। ৩য় বিভক্তি : চোর কর্তৃক সম্পদ অপহৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বলাকা রচিত। তার দ্বারা কিছুই হবে না। ৪র্থ বিভক্তি : সকলকে সেখানে যেতে হবে। আমাকে দশ পৃষ্ঠা পড়তে হবে। ৫ম বিভক্তি : আমা হতে এ কাজ হবে না। ৬ষ্ঠী বিভক্তি : আমার ভাত খাওয়া হয়েছে। তোমার যাওয়া প্রয়োজন। কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা। আজ রাতে তার শোয়া হবে না। ৭মী বিভক্তি : পাখিতে ধান খায়। ছাগলে কি না বলে। পাগলে কি না কয়।
২) কর্মকারক: কর্তা যে কর্ম করে তাকে কর্মকারক বলে। অন্য কথায় ক্রিয়ার সাথে কর্মের যে সম্পর্ক তা-ই কর্মকারক। কর্মকারকে সাধারণত দ্বিতীয়া বিভক্তি হয়।
রহিম ভাত খায়। খোকন বই পড়ে। এখানে রহিম ও খোকনের কাজের বিষয় বা কর্ম হল ভাত ও বই। অর্থাৎ ভাত ও বই ক্রিয়ার সাথে কর্ম সম্পর্কিত। অর্থাৎ কর্মকারক।
কর্মকারকে বিভিন্ন বিভক্তি যোগ: কর্মে শূন্য বা প্রথমা বিভক্তি : ইব্রাহিম বই পড়ে। খুব যন্ত্রণা পেলাম। বুদ্ধি খাঁটিয়ে কাজ কর। সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। চোর ধরা পড়েছে। ২য়া বিভক্তি : ব্যথিত লোকের সেবা কর। শিক্ষককে ভক্তি কর। আমাকে শুনতে হবে। ডাক্তারকে ডাক। ষষ্ঠী বিভক্তি : শিক্ষক তোমাদের পড়ান। তোমার দেখা পাচ্ছি না। ৭মী বিভক্তি : অন্ধজনে দয়া করো। বিপদে সাহসী হতে হয়। গুরুজনে কর ভক্তি। ফুলদল দিয়া কাটিলা বিধাতা শাল্মলী তরুবরে? আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাখবে? গৌণকর্ম ও মুখ্যকর্ম : দ্বিকর্মক বাক্যে প্রাণিবাচক কর্মকে গৌণকর্ম ও বস্তুবাচক বা অপ্রাণিবাচক কর্মকে মুখ্যকর্ম বলা হয়। প্রাণিবাচক কর্মের একচবনে কে, রে, এরে এবং বহুবচনে দিগকে বা দেরকে বিভক্তি যুক্ত হয়। অন্যদিকে অপ্রাণিবাচ বা বস্তুবাচক কর্মে শূন্যবিভক্তি থাকে। উদাহরণ : বাবা ছেলেকে কতকগুলো আম দিল। ছেলেকে গৌণকর্ম, আম মুখ্যকর্ম। উদ্দেশ্য কর্ম ও বিধেয় কর্ম : দ্বিকর্মকে বাক্যে উদ্দেশ্য অর্থবোধক কর্মকে উদ্দেশ্য কর্ম ও বিধেয়বোধক কর্মকে বিধেয় কর্ম বলে। যেমন-প্রজারা এক রাখালকে (উদ্দেশ্য কর্ম) রাজা (বিধেয় কর্ম) নির্বাচিত করল। যাদুকর একটি বেগুনকে (উদ্দেশ্য কর্ম) ডিম (বিধেয়) বানাল।
৩) করণ কারক: যেভাবে বা যার দ্বারা কর্তা ক্রিয়া সম্পন্ন করে তাকে করণ কারক বলে। করণ কারকে সাধারণত তৃতীয়া বিভক্তি হয়। করণ কারকে একবচনে তৃতীয়া বিভক্তি ‘এ’, ‘য়’, তে কিংবা ‘দ্বারা’, ‘দিয়া’, ‘কর্তৃক’ বিভক্তি বসে। কখনও ‘দ্বারা’ দিয়ে ষষ্ঠী বিভক্তি হয়। ‘দিয়া’ শব্দযোগে দেবতা ও মনুষ্যবাচক শব্দে ‘কে’ বিভক্তি হয়। যেমন- মনে ভাব (এ বিভক্তি)। কাঁথায় শীত ভাঙ্গে (য় বিভক্তি)। সে ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করে (তে বিভক্তি)। কাঁটা দিয়া কাঁটা বের কর। রাজা কর্তৃক প্রজার উপকার হয়।
করণ কারকে বিভিন্ন বিভক্তি: শূন্য বা প্রথমা : আমরা ফুটবল খেলতে যাচ্ছি। রবীন তাস খেলে (তাস দ্বারা খেলে বুঝাতে)। শয়তানকে চাবুক মার। ২য়া বিভক্তি : পুরাতন তাসকে খেলা যায় না।
৩য়া বিভক্তি : দা দিয়ে বাঁশ কাটে। মন দিয়া কর সবে বিদ্যা উপার্জন। তুমি নৌকা করে যাও। সে কি বলে এ কাজ করল। শ্রম বিনা ধন লাভ হয় না (তৃতীয়া বিভক্তির লোপ হয়েছে বিনা শব্দ দিয়ে)।
৫মী বিভক্তি : আমা হতে এ কাজ হবে না। খারাপ রঙ হতে ভাল ছবি হয় না।
ষষ্ঠী বিভক্তি : তোমাকে একবার চোখের দেখা দেখব। নখের আঁচড় (নখ দ্বারা আঁচড়) দিও না। কালির দাগ দাও। ৭মী বিভক্তি : ফুলে ফুলে সাজানো ঘর। আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি। টাকায় কিনা হয়। ঝরণা কলমে ভালো লেখা হয়। পাপে মৃত্যু। সাধনায় সিদ্ধি লাভ হয়। আলোয় আঁধার কাটে। নিজ হাতে কাজ করা বুদ্ধিমানের কাজ।
৪) সম্প্রদান কারক: যাকে উদ্দেশ্য করে দান করা হয় বা ক্রিয়া দ্বারা যা বা যাকে উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায় করা হয় তাকে সম্প্রদান কারক বলে। অনেক ব্যাকরণবিদ সম্প্রদান কারককে কর্মকারক হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্প্রদান কারককে ব্যাকরণ থেকে তুলে দেয়াকে অযৌক্তিক মনে করেন। তাঁর যুক্তি, কর্মে বিভক্তি লোপ পায় কিন্তু সম্প্রদান কারকে বিভক্তি লোপ পায় না। ধোপাকে কাপড় দাও- এখানে দান বোঝায় না, কাজেই তা সম্প্রদান কারক নয়।
সম্প্রদান কারকে ব্যবহৃত বিভক্তি: ২য়া বিভক্তি : সে ভিখারিকে একটি বস্ত্রদান করছে (নি:স্বার্থভাবে দান করা বুঝাতে)। নীলুকে ঘড়ি কিনে দাও। ৪র্থী বিভক্তি : সম্প্রদান কারকে চতুর্থী বিভক্তির প্রয়োগ বেশি। কে দ্বিতীয়া বিভক্তি কর্মকারকে হয়। অন্যদিকে ৪র্থী কে সম্প্রদান কারকে ব্যবহৃত। দ্বিতীয়া বিভক্তি লোপ পায়, তবে চতুর্থী বিভক্তি কখনো লোপ পায় না। সৎ পাত্রকে কন্যা দান কর। দরিদ্রকে ধন দাও। কাহাকেও হিংসা করো না। নিমিত্ত অর্থে ৪র্থী বিভক্তি হয় : বেলা যে পড়ে এলো জলকে চল। তিনি হজ্জে যাবেন।
৫) অপাদান কারক: যে স্থান হতে ঘটনার আরম্ভ বা যা কোন ব্যক্তি বা বস্তুর উৎপত্তি, চলন, উত্থান, পতন সংঘটিত হয় তাকে অপাদান কারক বলে। অন্য কথায়, যা হতে ক্রিয়া প্রকাশিত হয় তাকে অপাদান কারক বলে। যথা : গাছ হতে ফল পড়ে। ঘি হতে দুধ হয়। এখানে ‘পড়ে’ ও ‘হয়’ ক্রিয়া দুটি যথাক্রমে গাছ ও দুধ হতে প্রকাশিত। এরা অপাদান কারক। অপাদান কারকে সাধারণত হতে, থেকে, চেয়ে প্রভৃতি বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। এগুলো ৫মী বিভক্তি। এছাড়া এ, য়, তে বিভক্তিও ব্যবহৃত হয়।
বিভিন্ন বিভক্তির প্রয়োগ: শূন্য বা প্রথমা বিভক্তি : ট্রেন ঢাকা ছাড়ল। নদী থেকে পানি আন। ছেলেটি স্কুল পালায়। বাড়ি ঘুরে এলে টাকা দেব। ২য়া বিভক্তি : সে তোমাকে ভয় পায়। বাবাকে ভয় হয়। ৩য়া বিভক্তি : মুখ দিয়া অশ্লীল কথা বের হল। তাঁর ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। ৫মী বিভক্তি : বিপদ হতে রক্ষা করো। অফিস হতে শফিক বের হল। গাছ থেকে ফল পড়ে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম দূরের পথ। তিল হতে তৈল হয়। মেঘ থেকে বৃষ্টি পড়ে। ৬ষ্ঠী বিভক্তি : যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়। সুখের চেয়ে শান্তি ভালো। ইব্রাহিম ক্লাসের মধ্যে সেরা। ৭মী বিভক্তি : পরাজয়ে ডরে না বীর। বিপদে মোরে রক্ষা কর। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। পাঠে বিরত হও না।
৬) অধিকরণ কারক: যাতে ক্রিয়া সম্পন্ন হয় তাকে অধিকরণ কারক বলে। অন্য কথায় ক্রিয়ার আধারকে (পাত্র বা স্থান) অধিকরণ কারক বলে। এই কারকে এ তে, ও, য় বিভক্তি বসে। অর্থাৎ অধিকরণ কারকে ৭মী বিভক্তি বেশি ব্যবহৃত হয়। অধিকরণ কারককে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। নিচে প্রত্যেক প্রকারের উদাহরণসহ উল্লেখ করা হল:
(ক) স্থানাধিকরণ : এ ভাগে স্থান বোঝায়। বাংলাদেশ নদীর দেশ। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। বনে বাঘ থাকে। মাঠে ধান-পাঠ জন্মে। (খ) কালাধিকরণ : সময় বোঝাতে কালাধিকরণ কারক হয়। প্রভাতে সূর্য ওঠে। বসন্তে কোকিল ডাকে। রাত্রে নীরবতা আসে। আসছে ফাল্গুনে তার বিয়ে। (গ) বিষয়াধিকরণ : ধর্মে মন দাও। সে সাহিত্যে অভিজ্ঞ। তিনি ত্যাগে অতুলনীয়। (ঘ) ভাবাধিকরণ : বড় দু:খে সে আত্মহত্যা করেছে। সুখে সময় কাটায় সে। (ঙ) ব্যাপ্তি অধিকরণ : তিলে তৈল থাকে। দুধে ঘি থাকে। নদীতে মাছ থাকে।
অধিকরণ কারকে বিভিন্ন বিভক্তির ব্যবহার: ১মা বিভক্তি : আজরফ কাল বাড়ি যাবে। রোববার স্কুল খুলবে। আমি ঢাকা যাবো না। ২য়া বিভক্তি : ঘরকে যাও। ৩য়া বিভক্তি : ছায়াযুক্ত পথ দিয়ে যেতে আরাম। ৫মী বিভক্তি : ছাদ হতে নদী দেখা যায় (ছাদে বসে)। গাছের ডালে বানর ঝোলে। ষষ্ঠী বিভক্তি : এ নদীর মাছ সুস্বাদু। ৭মী বিভক্তি : তিলে তৈল থাকে। রাত্রে দেখা যায়। পুকুরে মাছ আছে। সমুদ্রে লবণ আছে। সে বিপদে পড়েছে। কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল। এ ঘরে অনেক বই আছে।
বিভিন্ন কারকে শূন্য বিভক্তি: কর্তা : জল পড়ে, পাতা নড়ে। কর্ম : রকিব বই পড়ে। করণ : ছেলেরা তাস খেলে। সম্প্রদান : ভিক্ষা দাও দুয়ারে ভিক্ষুক। অপাদান : ট্রেন রাজশাহী ছাড়ল। অধিকরণ : বাবা বাড়ি নেই, আমি ঢাকা যাব।